বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের অর্থনীতি হলো কৃষিনির্ভর। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান অসুবিধার কারণে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বৃদ্ধিজনিত লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান হ্রাস পেয়ে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. কৃষির অবদান :
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একক বৃহত্তম খাত। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির বিভিন্ন উপখাতের (ফসল, পশুসম্পদ, মৎস্য সম্পদ ও বনজ সম্পদ) সমন্বিত অবদান শতকরা প্রায় ২১.১১ ভাগ।
২. কৃষির ক্রমোন্নতি :
বর্তমানে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের বাতাস বইছে। উৎপাদকগণ পূর্বাপেক্ষা অধিক সচেতন ও দায়িত্ববান। ভাই গুরুত্ব অনুভব করে তারা উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধার বন্দোবস্ত করে অধিক উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছে।
৩. মূলধনের অভাব :
বাংলাদেশের অর্থনীতির আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মূলধনের স্বল্পতা। বাংলাদেশের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় কম বলে লোকের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও কম। ফলে বাংলাদেশের মূলধন গঠনের হার অত্যন্ত কম।
৪. শিল্পে অনগ্রসরতা :
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শিল্পে অনগ্রসরতা। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক শিল্পনীতির অভাবে স্বাধীনতা লাভের ৪০ বছর পরেও বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় শিল্প ও কলকারখানা গড়ে উঠে নি। ফলে বাংলাদেশ শিল্পক্ষেত্রে অনুন্নত রয়েছে।
৫. বেকার সমস্যা:
বাংলাদেশে তীব্র বেকার সমস্যা বিরাজমান। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় বাংলাদেশে সঞ্চয় মূলধন গঠনের হার কম। এর ফলে বিনিয়োগ আশানুরূপ নয়। তাই বেকার সমস্যার তেমন উন্নতি হয় নি। তবে বৈদেশিক বিনিয়োগকারিগণ যেহেতু এদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে EPZ চালু হচ্ছে, আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যা হ্রাস পাবে।
৬. খাদ্য ঘাটতি :
কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি বিদ্যমান। সরকারের গৃহীত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (ADP) মাধ্যমে ধীরে ধীরে খাদ্য ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
৭. অদক্ষ জনশক্তি :
বাংলাদেশে কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিল্প ও কারিগরি শিক্ষার অভাবে বাংলাদেশের জনশক্তি অদক্ষ। ফলে শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা অত্যন্ত কম।
৮. শিক্ষার অভাব :
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও নিরক্ষর। ফলে শ্রমিকরা উৎপাদনের আধুনিক কলাকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এজন্য তাদের উৎপাদন ক্ষমতাও কম ।
৯. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো :
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা কম। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যা অত্যন্ত অপ্রতুল তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গুলো ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে।
১০. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার :
বাংলাদেশের অর্থনীতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার। বাংলাদেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন, দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার সম্ভব হয় না।
১১. বৈদেশিক বাণিজ্য :
বৈদেশিক বাণিজ্যে পূর্বে প্রচুর ঘাটতি ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন বন্ধুদেশে আমাদের দেশের পণ্যদ্রব্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাচ্ছে। তবে এখনো বৈদেশিক বাণিজ্য অনুকূলে আসে নি।
১২. অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা :
বাংলাদেশের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। বাংলাদেশে সড়ক ও রেলপথ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আমাদের জলপথ এবং বিমানপথও উন্নত নয়। অনুন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
১৩. সামাজিক কুসংস্কার :
বর্তমানে শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির ফলে সামাজিক নানা কুসংস্কার নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। বর্ণবৈষম্য, পর্দা প্রথা, বাল্য ও বহু বিবাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে।
১৪. কারিগরি জ্ঞানের প্রসার:
দেশে বর্তমানে যুবকদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানের যথেষ্ট প্রসার ঘটছে। কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহণ করে এর নানামুখী ব্যবহারের প্রতি যুবকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৫. পরিকল্পনা :
সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য দেশপ্রেমিক ও দক্ষ পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের সাহায্যে সঠিক বাস্তবানুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করছে।
১৬. দক্ষ উদ্যোক্তা সৃষ্টি :
বর্তমানে আমাদের উৎপাদিত অনেক পণ্যদ্রব্য বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করেছে। দেশীয় দক্ষ উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৭. প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ :
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিকূল সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবেশ, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুকূল নয় ।
১৮. অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় :
বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষার জন্য অধিক ব্যয় হয়। এসব অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়াধিক্যের জন্য উন্নয়ন খাতে ঘাটতি দেখা দেয় ।
১৯. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব :
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব। দীর্ঘকাল পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকার ফলে বাংলাদেশে কোন শক্তিশালী এবং স্থায়ী সরকার গড়ে উঠে নি। ফলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
২০. নিম্ন উৎপাদনশীলতা :
এদেশে উন্নত কলাকৌশল, কারিগরি জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবে শ্রম ও মূলধনের উৎপাদনশীলতা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের, যা আয় বৃদ্ধিতে প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেছে।
২১. দারিদ্র্য বিমোচন :
দারিদ্র্য বিমোচন তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুমাত্রিক জটিল ও বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চহারে বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দরিদ্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে তাদের মাথাপিছু আয় ও ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২২. বিনিয়োগের অনুপযুক্ত পরিবেশ :
অনুন্নত অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশি ও বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প মাথাপিছু আয় ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান, কৃষির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা, শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা, শিক্ষার অভাব, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব প্রভৃতি।
0 Comments