ভারসাম্য ও অভারসাম্য প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য
অথবা
সুষম ও অসম প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্যঃ
(Difference between Balanced and Unbalanced Growth)
যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিতে অর্থনীতির সকল উৎপাদন ক্ষেত্রে (কৃষি, শিল্প, সেবা) একযোগে সমান হারে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় তাকে ভারসাম্য উন্নয়ন বা সুষম প্রবৃদ্ধি বলা হয় । অন্যদিকে, যে পদ্ধতিতে অর্থনীতিতে কয়েকটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ কেন্দ্ৰীভূত করে উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো হয় তাকে অভারসাম্য উন্নয়ন প্রক্রিয়া বা অসম প্রবৃদ্ধি বলা হয়।
নিম্নে সুষম ও অসম প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্যসমূহ তুলে ধরা হলোঃ
১। সুষম প্রবৃদ্ধির সমর্থক অর্থনীতিবিদ Rosenstein-Rodan মনে করেন, পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত অনেকগুলো শিল্পে একযোগে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের মাধ্যমে ভারসাম্য প্রবৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে একটি অন্য শিল্প-কারখানার বাজার হিসেবে গড়ে উঠলে শিল্পসমূহ পারস্পরিকভাবে সমর্থিত হয়ে বিভিন্ন খাতের ভারসাম্য উন্নয়ন সুনিশ্চিত হবে।
অন্যদিকে, অভারসাম্য প্রবৃদ্ধির সমর্থক অর্থনীতিবিদ H. Singer মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশে অপর্যাপ্ত মূলধনের কারণে ভারসাম্য প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই উন্নয়নশীল দেশসমূহ তাদের সীমিত মূলধনের দ্বারা প্রথমে নেতৃস্থানীয় খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে উন্নয়নের সুফল দ্বারা অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করে উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে একসময় অর্থনীতিতে ভারসাম্য প্রবৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ অর্থনীতির একটি খাতের উন্নয়নের সুফল অন্যখাতে বিনিয়োগ করে এর উন্নয়ন দ্বারা এক সময় ভারসাম্য প্রবৃদ্ধি সৃষ্টি হবে ।
২। অধ্যাপক Ragner Nurkse মনে করেন, অনুন্নত দেশে ভয়াবহ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ভেঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার স্বার্থে বিভিন্ন খাতে একযোগে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই । তাঁর মতে, অনেকগুলো খাতে একযোগে বিনিয়োগ করা গেলে উৎপাদন ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সুবিধা ছাড়াও পরিপূরক দ্রব্য চাহিদার কারণে পণ্যের বাজার বিস্তৃত হবে ।
কিন্তু হার্সম্যান এর মতে, উন্নয়নশীল দেশসমূহ অনেকগুলো শিল্পে একযোগে বিনিয়োগ করার মত প্রাকৃতিক সম্পদ, দক্ষ জনশক্তি, প্রয়োজনীয় শিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিল্পোদ্যোক্তা নেই বললেই চলে। তাই অধ্যাপক হার্সম্যান উন্নয়নশীল দেশসমূহে অসম উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করার পক্ষে জোড়ালো মত প্রকাশ করেন ।
৩। সুষম প্রবৃদ্ধির জন্য সুস্থ রাজনীতি ও সুশাসন, স্থিতিশীল আর্থ-সামজিক পরিবেশ থাকা দরকার । কিন্তু অনুন্নত দেশসমূহে বিভিন্ন রকম অশিক্ষা, কুসংস্কার, সামাজিক অনাচার, দুর্নীতি, জনগণের সম্পদ লুটপাট ইত্যাদি কারণে সুষম উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব নয় । এজন্য অনুন্নত দেশসমূহে নেতৃস্থানীয় খাতসমূহে সরকারি সহায়তায় উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করলে বরং বেশি সুফল পাওয়া যাবে।
৪। কৃষি, শিল্প ও সেবাসহ সকল খাতে একযোগে বিনিয়োগ করার মত উন্নয়ন ব্যয় ও উৎপাদন ব্যয় নির্বাহ করা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য অভারসাম্য প্রবৃদ্ধির দিকেই বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত ।
৫ । সুষম প্রবৃদ্ধি কৌশল প্রয়োগের ফলে দেশের কৃষি, শিল্প, সেবা, গ্রামীণ ও শহরে খাতের মধ্যে একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে যা একটি দেশের সুষম বণ্টন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। কিন্তু অসম প্রবৃদ্ধির কৌশলের ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশসমূহে নেতৃস্থানীয় ও অগ্রসর খাতসমূহ আরও এগিয়ে যাবে এবং পশ্চাৎপদ খাতগুলো পিছিয়ে থাকবে। ফলে অনুন্নত দেশসমূহে সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য আরও বাড়বে ।
৬। সুষম প্রবৃদ্ধি কৌশলে বেসরকারি খাতের সরাসরি উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোন বক্তব্য দেওয়া হয়নি। কিন্তু অসম প্রবৃদ্ধির কৌশলে বলা হয়েছে সরকার প্রথমে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামোর উন্নয়ন করবে এবং এর ফলে বেসরকারিখাত উৎসাহিত হয়ে সরকারি উৎপাদনশীল খাতে অংশগ্রহণ করবে । অর্থাৎ অসম উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি খাতে সমন্বিত উন্নয়ন প্রচেষ্টার দিকে জোর দেওয়া হয়েছে।
৭ । উন্নত দেশসমূহের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশীরভাগ উন্নত দেশ অসম উন্নয়ন কৌশল প্রয়োগ করেই অর্থনৈতিক সাফল্য লাভ করেছে। কোন দেশই উন্নয়নের শুরুতে সুষম উন্নয়ন কৌশল প্রয়োগ করেনি ।
0 Comments