TOP Menu

মার্কিন মুদ্রা ডলার কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, এর কী কোন বিকল্প হতে পারে?

ধরি, আপনি থাইলেন্ডে বেড়াতে যাবেন অনলাইনে আপনি হোটেল বুকিং দিতে চাইলেন আপনাকে ডলারের পেমেন্ট করতে হবে। অন্য মুদ্রাতেও আপনি পেমেন্ট করতে পারবেন কিন্তু ডলারের মূল্য পরিশোধ করা তুলনামূলক সহজ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। 

এটাতো গেল ব্যক্তি পর্যায়ের কথা... 


মার্কিন ডলার কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, এর বিকল্প কী হতে পারে?
মার্কিন ডলার কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে, এর বিকল্প কী হতে পারে?


বর্তমান পৃথিবীতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যখন কোন কিছু ক্রয় করে তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। যেমন ধরুন বাংলাদেশ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে তার সব কিছুর বিনিময় মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারের মাধ্যমে এছাড়া যা কিছু রপ্তানি করে তার বিনিময় মূল্য বুঝে নেয় ডলারের মাধ্যমে। এভাবে পৃথিবীতে যত লেনদেন হয় তার ৮০ ভাগেরও বেশি হয় আমেরিকান ডলারের মাধ্যমে। বিশ্ব নিয়ন্ত্রন করছে আমেরিকান ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে: এটাকি হতেই হবে? এর কি কোন বিকল্প নেই? আমেরিকান ডলারের বিপরীতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান কিংবা রাশিয়ার মুদ্রার রুবেল কি বিকল্প হতে পারবে? ইউক্রেন যুদ্ধের পর সে প্রশ্ন আরো জোরেশোরে উঠতে শুরু করেছে। চলুন তাহলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।


কিভাবে ডলারের আধিপত্য তৈরি হয়েছে: 

বহু বছর ধরেই পৃথিবীতে স্বর্ণের মানের উপর নির্ধারিত হতো অর্থনীতি ও লেনদেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে সামরিক এবং বেসামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে সেগুলোর মূল্য পরিশোধ করা হয়েছিল স্বর্ণের মাধ্যমে। এর ফলে বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৭০ ভাগ স্বর্ণ চলে যায় আমেরিকার হাতে। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ৪৪ টি মিত্র দেশ একত্রিত হয়ে একটি চুক্তি করে যার নাম ছিল ব্রিটেনউডস এগ্রিমেন্ট। যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, বিভিন্ন দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারিত হবে আমেরিকান ডলারের উপর ভিত্তি করে অন্যদিকে আমেরিকান ডলারের মূল্য নির্ধারিত ছিল তখন স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে। সে সময় ধনী রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে আমেরিকায় ছিল একমাত্র দেশ যেখানে যুদ্ধের কোন আঁচড় লাগেনি। এছাড়া ইউরোপ ছিল তখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত। যেহেতু তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ আমেরিকার কাছে ছিল এবং স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে আমেরিকান ডলার স্থিতিরশীল ছিল সেজন্য ৪৪ টি দেশ ডলারকে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে একমত হয়েছিল। সেই থেকেই ডলারের আধিপত্য শুরু। 


তেল ও ডলার:

১৯৭১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিসার্চ নিক্সন ঘোষণা করেন যে, স্বর্ণের উপর ভিত্তি করে ডলারের মূল্য আর নির্ধারিত হবে না। বিশ্বজুড়ে আমেরিকান ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে এবং চাহিদা বাড়ানোর জন্য ১৯৭৩ সালে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে আমেরিকা। সেই চুক্তিতে বলা হয় সৌদি আরব তেল বিক্রি করবে শুধু আমেরিকান ডলারে। এর বিনিময়ে সৌদি আরবকে প্রতিবেশী দেশগুলোর আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিল আমেরিকা। ১৯৭৫ সালে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন অর্থাৎ তেল উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশগুলো সৌদি আরবের মতোই সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তেল বিক্রি করা হবে আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে। 


ডলারের বিকল্প চিন্তা: 

সৌদি আরব এবং চীনগত ৬ বছর যাবত আলোচনা করছে যাতে করে চীনের কাছে সৌদি আরব যে তেল রপ্তানি করে সেটির মূল্য ডলারে পরিশোধ না করে চীনের মুদ্রা ইউানে পরিশোধ করা যায় কিনা এ ব্যাপারে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এ আলোচনা আবার নতুন করে সামনে এসেছে। সৌদি আরব যত তেল রপ্তানি করে তার ২৫ শতাংশ যায় চীনে। কিন্তু ডলার বাদ দিয়ে লেনদেনের বিষয়ে সৌদি আরব এবং চীন এখনো একমত হতে পারেনি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, খুব দ্রুত সেটি হবার সম্ভাবনাও নেই। গত ৫০০ বছর ধরে পৃথিবীতে যেসব দেশের মুদ্রার রাজত্ব করছে তার মধ্যে রয়েছে পর্তুগাল এরপর স্পেন তারপর নেদারল্যান্ড তারপর ফ্রান্স এবং সর্বশেষ ছিল বৃটেনের মুদ্রা। এরপর থেকেই আমেরিকান ডলারের প্রভাব শুরু।


ডলার কি রাজত্ব করেই যাবে?: 

একটা কথা প্রচলিত আছে যে, "কোন রাজার রাজত্ব চিরস্থায়ী হয় না"। ঠিক একই কথা আমেরিকার মুদ্রা ডলারের ক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর সে প্রশ্ন নতুন করে আবারও উঠতে শুরু করেছে। একটি দেশ অপর আরেকটি দেশ থেকে কোন পণ্য কিনলে সেটির মূল্য পরিশোধ করা হয় ডলারে। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেবার পর দেশটি বলছে, যারা তাদের কাছ থেকে তেল-গ্যাস কিনবে তাদের কে মূল্য পরিশোধ করতে হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবেলের মাধ্যমে। চীন এবং রাশিয়া দীর্ঘদিন যাবত ডলারের বিকল্প হিসেবে নতুন একটি বৈশ্বিক মুদ্রা চালুর কথা বলছে। কিন্তু সেটি এখনো হালে পানি পাইনি। চীন এবং রাশিয়া চায় ডলারের বিকল্প হিসেবে এমন একটি মুদ্রা হোক যেখানে কোন দেশের প্রভাব থাকবে না। অনেকে ধারণা করেছিলেন চীনের মুদ্রা ইউয়ান ডলারের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে কিন্তু সেটি এখনো হওয়া সম্ভব নয়। মার্কিন অর্থনীতির নীতি ও স্বচ্ছতার কারণে ব্যবসা এবং বিনিয়োগকারীরা ডলারের উপরেই তাদের আস্থা রাখছেন। চীনের মুদ্রা ইউয়ান রাশিয়ার মুদ্রা রুবল ইউরোপের ইউরো এসব মুদ্রা ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারত বলে অনেকে ধারণা করেন কিন্তু সেটি বাস্তবে সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে, ইউয়ান এবং রুবল বাজারের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না। এসব মুদ্রার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো হস্তক্ষেপ করে। অন্যদিকে ইউরো কোন একটি দেশের একক মুদ্রা নয়, ইউরোর উপর কোন একটি দেশের একক কর্তৃত্ব নেই। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সব হিসেব-নিকেশ মিলিয়ে দেখলে দেখা যায় লেনদেন সুবিধা এবং আস্থার জায়গা থেকে আমেরিকান ডলার অন্যদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।


ভবিষ্যতে কি ঘটতে চলেছে: 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ২০১৬ সালে চীনের মুদ্রাকে বিশ্বের অন্যতম ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আই এম এফ এর হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে যত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে তার মাত্র ২.৯৭ শতাংশ চীনের মুদ্রায়। যেটি আমেরিকান ডলারের ধারের কাছেও নেই। অন্যদিকে আমেরিকান ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৫৮.৮১শতাংশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইউরো ২০.৬৪ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর গীতা গোপীনাথ সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার উপর অবরোধ দীর্ঘমেয়াদী হলে সেটি আমেরিকান ডলারের জন্য খারাপ হবে। ব্রিটেনের ফিনান্সিয়াল টাইমস সংবাদপত্রকে তিনি বলেছেন, ডলার বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা হিসেবে থাকবে ঠিকই কিন্তু এর সাথে লেনদেনের স্বার্থে কিছু দেশ অন্য মুদ্রা ব্যবহার করাও শুরু করবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের যে রিজার্ভ রাখে সেটিও হয়তো তারা কমিয়ে অন্য মুদ্রায় রাখতে পারে ফলে ডলারের চাহিদা কমতে পারে। আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ও আর্থিক সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেম্যান শ্যাস সাম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে ১৯২০ সালের দিকে ব্রিটিশ পাউন্ড তাদের আধিপত্য হারানোর আগে যে ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল এখন আমেরিকান ডলারের ক্ষেত্রেও তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গোল্ডেম্যান শ্যাস বলছে আমেরিকা এবং ইউরোপে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া তার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রায় অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে না। এসব বৈদেশিক মুদ্রা ডলার এবং ইউরোতে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনার পর পৃথিবীর অনেক দেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে ডলারের উপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারে বলে তারা মনে করছে। তবে সেটি এখনই হচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন ডলারের আধিপত্য কমে আসতে আরো হয়তো কয়েক দশক সময় লাগতে পারে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পরে সেটি নিয়ে অনেকের মাঝে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। 


#আর্টিকেলটি শেষ অব্দি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Post a Comment

0 Comments